মোহাম্মদ জুবায়ের, চট্টগ্রাম : দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল এখনো আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রভাব ও দুর্নীতির কব্জায় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের এক বছর পরেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অফিস, প্রিন্সিপাল অফিস এবং বিভিন্ন শাখায় আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেট ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এই প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে হাজারো নিরীহ কর্মকর্তা ও কর্মচারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, যার ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আওয়ামী লীগ ও তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন যেমন বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং স্বাধীনতা স্বপক্ষীয় ব্যাংকার ফোরামের মাধ্যমে নিয়োগ, বদলি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে, চট্টগ্রামের জেনারেল ম্যানেজারস অফিস (সাউথ) এর জিম (ইনচার্জ) মোঃ ফোরকানের নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে ফোরকান বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দকে ব্যবহার করে জিএম অফিস, প্রিন্সিপাল অফিস এবং বিভিন্ন শাখা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি জিএম মোঃ মুসা খানকে বিতাড়িত করার ষড়যন্ত্র করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ:
মোঃ ফোরকান: জিএম (ইনচার্জ) হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের বলয়কে শক্তিশালী করছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গুরুতপূর্ণ পদে নিয়োগ ও বদলি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
জান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ: বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে আওয়ামীপন্থীদের পদায়ন ও সুবিধা প্রদানে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
আরিফা আফরিন: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্প্রতি সাসপেন্ড হয়েছেন।
মোঃ মলকুতুর রহমান: পাঁচলাইশ শাখার ম্যানেজার হিসেবে ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও আওয়ামীপন্থীদের সুবিধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে।
মোহাম্মদ আজগর আলী: দেওয়ান হাট মিঠা গলি শাখার ম্যানেজার হিসেবে ১৬ বছর ধরে চট্টগ্রামে ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন।
এ বি এম খালেদুজ্জামান: ধনিয়ালাপাড়া শাখার ম্যানেজার হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সমর্থনে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করছেন।
রাশেদুল ইসলাম: সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ১৫ বছর ধরে ব্যাংক কলোনিতে বিনা ভাড়ায় থাকা এবং ফাইল প্রক্রিয়াকরণে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রভাব: বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃত্বে গঠিত একটি পাল্টা কমিটি, যার মধ্যে জান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, খালিদ রশিদ, রানা অমিতাভ দাশ প্রমুখ রয়েছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সোনালী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে আরিফা আফরিন, এবিএম খালেদুজ্জামান, সুচন্দ্রা চৌধুরী, মিন্টু রাম দাস, মূলকুতুবুর রহমান, উজ্জ্বল কান্তি দে, চন্দন চক্রবর্তী, মোহাম্মদ আজগর আলী, মোস্তফা নাজমুল কাউসার, শুভাশীষ ঘোষ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। এছাড়া, খোরশেদ আলম, এ কে এম আহসান আরিফ, হাসান তারেক, রানী দাশ, সুমন কুমার নাথ, আসাদ আলী, আবুল হাসনাত মোঃ আব্দুল্লাহ, শিপ্রা রানী মজুমদার, অর্পিতা বড়ুয়া, জুয়েল পান্থ, রাজীব রায় চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন চৌধুরী, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ আসাদ প্রমুখ বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও স্বাধীনতা স্বপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমে ১৫-২০ বছর ধরে চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করছেন।
কর্মচারীদের ক্ষোভ ও দাবি: সোনালী ব্যাংকের সৎ ও নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই আওয়ামীপন্থী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এই গোষ্ঠী ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিচ্ছে এবং বদলি ও পদোন্নতিতে বৈষম্য করছে। কেউ কেউ এখন জিয়া পরিষদে যোগ দিয়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করছেন। কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন যে এই সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ কর্মচারীরা হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সতর্ক করেছেন যে, অচিরেই সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে এই আওয়ামী দোসরদের বদলি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ব্যাংকিং খাতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এই অবস্থা জনগণের আস্থা ও ব্যাংকের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় দুর্নীতি, অনিয়ম ও বৈষম্যের অভিযোগ উঠছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। সোনালী ব্যাংকের সুনাম ও জনগণের সম্পদ রক্ষার জন্য অবিলম্বে সংস্কার ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।