২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঈদুল আযহা উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের ওপর আপনাদের অর্পিত ম্যান্ডেট ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারব। সে বিবেচনায় ও ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। পাশাপাশি, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এমন নির্বাচন চাই যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকুক।’
দেড়যুগ পরে দেশে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিপুল তরুণ গোষ্ঠী এবার জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তাঁরা অনুমোদন করেন।
তিনি বলেন, আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনও কোনো প্রকার আপস করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেবেন এই মর্মে যে তারা কখনোই, কোনো অবস্থাতেই আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবেন না।’
জাতীয় নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে দেশবাসীর আগ্রহ রয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনুস বলেন,‘আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।’
তিনি আরো বলেন, এখানে মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে যতবার গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন।
ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের দায়িত্ব হলো এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।
সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার- যা কি না জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়- সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব।
ড. ইউনূস দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, আমি আপনাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলোই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলোই থাকবে। কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত। কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা এই নির্বাচনে ভোটার হবো তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সৌভাগ্যবতী। আমরা একটা অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা জাতির নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির মহান সুযোগটা পাচ্ছি। আমাদের সুচিন্তিত ভোটের মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে। আশা করি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই সবাই ভোটকেন্দ্রে যাবো এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ভোট দেবো। এখন থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করুন। আলোচনা শুরু করুন। এখন থেকে আপনাদের ভোটের গুরুত্বটা বুঝে নিন। আপনার এবারের ভোটের গুরুত্ব ঐতিহাসিক মানদণ্ডে দেখা হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন
এ দিকে নির্বাচনের ঘোষিত সময় নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে দেশে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার যে ‘প্রতিশ্রুতি’ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দিয়েছেন, তাতে ‘জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।’
শুক্রবার রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমরা রাত ৯টায় স্ট্যান্ডিং কমিটি জরুরি বৈঠকে বসছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে এ বৈঠক হবে। সেখানে বিষয়টি আলোচনা হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানাব।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া দীর্ঘ ভাষণে অনেক কিছু বলেছেন। সরকারের কৃতিত্ব, কর্মকাণ্ড এবং ভবিষ্যতে কী করতে চান ইত্যাদি। এর ফাঁকে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
নির্বাচনের তারিখে বিলম্বে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পঞ্চাশের বেশি দল ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। আমরা যৌক্তিকভাবে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের বক্তব্য সবসময় যুক্তি সহকারে উপস্থাপন করেছি। সে বিষয়টি আমলে না নিয়ে এমন সময়ে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছেন, যে সময়ে পাবলিক পরীক্ষা থাকে, আবহাওয়া ঠিক থাকে না। এছাড়াও আমাদের জানামতে ফেব্রুয়ারির ১৬, ১৭ বা ১৮ তারিখের দিকে রমজান মাস শুরু হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে যদি নির্বাচন করতে হয়, তাহলে (৪৫ দিন যে সময়সীমা লাগে তফশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত) রমজানের মধ্যেই ক্যাম্পেইন করতে হবে। এটা একটা অযৌক্তিক ধারণা।
ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারতো উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, খুব বেশি দেরি করতে চাইলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হলেও সেটি মেনে নেওয়ার মতো বিষয় হতো।
উল্লেখ্য বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।