হাকিকুল ইসলাম খোকন: রাশিয়া তুরস্কের দানিউব (যা বর্তমানে রোমানিয়ায় অবস্থিত) অঞ্চলে আক্রমণ করলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৩-১৮৫৬) শুরু হয়। যুদ্ধে নিজেদের বাণিজ্যপথে রাশিয়ার সম্প্রসারণ প্রতিহত করতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স দুর্বল অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে।
এই যুদ্ধের প্রধান ময়দান হয়ে ওঠে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা করে। টানা তিন বছর লড়াই শেষে রাশিয়া নিদারুণভাবে হেরে যায়। এর পরই তারা ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে।
উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকান পিস সোসাইটি প্রকাশিত ‘অ্যাডভোকেট ফর পিস’ পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, ক্রিমিয়ার যুদ্ধের জন্য রাশিয়া তখনকার হিসাবে ১৬ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং খরচ করে।
এদিকে অতিরিক্ত শিকারের কারণে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলাস্কা থেকে খুব কম অর্থ আসছিল। অঞ্চলটি ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত কানাডার কাছে অবস্থিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন সহজেই ওই অঞ্চলের দখল নিয়ে নিতে পারবে বলেও আশঙ্কা ছিল।
১৮৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, আলাস্কা বিক্রি করলে রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করা যাবে এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলে ব্রিটেনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কা কিনতে আগ্রহ দেখায়, যার ফলে ১৮৬৭ সালে আলাস্কা কেনার চুক্তি হয়।
আলাস্কা ক্রয়ের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে গৃহীত হয়।
১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কেনার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ ওয়াশিংটন ৭.২ মিলিয়ন ডলারে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেয়।
এতে এর প্রতি একর জমির দাম পড়ে ২ সেন্টেরও কম। চুক্তি অনুযায়ী ওয়াশিংটন প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার জমি অধিগ্রহণ করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর প্রান্তে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। তবে আলাস্কা কেনার বিরোধীরা বলেন, এর দাম আরও কম। তারা আলাস্কা কেনাকে ‘সিওয়ার্ডের বোকামি’ বা ‘সিওয়ার্ডের বরফবাক্স’ বলে অভিহিত করেন।
১৮৬৭ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন লিখেছিল, ‘চুক্তির মাধ্যমে আমরা আসলে শুধু পেয়েছি অনতিক্রম্য তুষারের মরুভূমি, বিস্তীর্ণ বামনগাছের বন, পেয়েছি সিটকা আর প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপপুঞ্জ। বাকি সবই অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকা।’
তবে ১৮৯৬ সালে ক্লোনডাইকে সোনার খনি আবিষ্কারের পর আলাস্কা কেনার কঠোর বিরোধীরাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, আলাস্কা মার্কিন ভূখণ্ডে একটি মূল্যবান সংযোজন। সময়ের সাথে সাথে আলাস্কার কৌশলগত গুরুত্ব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে আলাস্কা অবশেষে একটি মার্কিন রাজ্যে পরিণত হয়।
আলাস্কার অর্থনীতি এখন কেমন?
বিশ শতকের গোড়ার দিকে সোনার খনি ছাড়াও আলাস্কার অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় হতে শুরু করে। বাণিজ্যিকভাবে মাছ ধরা, বিশেষ করে স্যামন ও হ্যালিবুট মাছ প্রধান শিল্পে পরিণত হয়। এরপর এখানে তামা খনির প্রসার ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলাস্কায় সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার ফলে সেখানে প্রথমবারের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়। জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৬৮ সালে। ওই বছর প্রুডহো বে-তে বিশাল তেলের খনি আবিষ্কার হয়।
তেলের রাজস্ব আয়ে সরকারি খরচ চলে এবং আলাস্কায় স্থায়ী তহবিল গড়ে ওঠে। শেয়ার, বন্ড ও আবাসনসহ নানা বিনিয়োগের মুনাফা থেকে নাগরিকদের বার্ষিক ভাতা দেওয়া শুরু হয়। এই অর্থ প্রদান ‘স্থায়ী তহবিল লভ্যাংশ’ নামে পরিচিত।
এতে নিশ্চিত হয়, আলাস্কার তেল সম্পদের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বাসিন্দারা এর আয় থেকে উপকার পাবে। এই ব্যবস্থার ফলে আলাস্কাকে কোনো রাজ্য আয়কর বা রাজ্য বিক্রয় কর দিতে হয়নি, যা যুক্তরাষ্ট্রে বিরল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলাস্কায় পর্যটনও দ্রুত বেড়েছে। জাতীয় উদ্যান ও হিমবাহ দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক আলাস্কায় যান। একসময় আলাস্কাকে উপহাসের কেনাকাটা বলা হতো। আজ সেটা বদলে পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও পর্যটনভিত্তিক সমৃদ্ধ রাজ্য। সূত্র : আল জাজিরা