মীর দিনার হোসেন: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা পূর্বে প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) চূড়ান্ত দফা আলোচনার পর এসেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই চুক্তিকে “কূটনৈতিক বিজয়” হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাক শিল্পকে সুরক্ষা দেবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ৭০টি দেশের উপর ৪১ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল, যা বাণিজ্য ভারসাম্য, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এই শুল্ক হ্রাস পোশাক শিল্পের জন্য স্বস্তির বিষয়, যা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং জিডিপির ৮ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি বাজার, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যার মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক।
শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্যও ১৯-২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে অক্ষুণ্ণ রাখবে বলে বাংলাদেশ আশাবাদী। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান আলোচক ড. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, “আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা করেছি। পোশাক শিল্পের সুরক্ষা আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল।”
যে চুক্তির শর্তাবলে কমলো মার্কিন শুল্ক: শুল্ক হ্রাসের বিনিময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতি বছর ৭০০,০০০ টন গম কেনা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বৃদ্ধি এবং ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার পরিকল্পনা। এছাড়া, সয়াবিন এবং তুলার আমদানি বাড়িয়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে। মার্কিন পক্ষ বাংলাদেশকে তাদের সামরিক সরঞ্জাম কেনার অনুরোধ জানিয়েছে, যদিও বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যের কারণে তুরস্ক এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকেও সরঞ্জাম কেনার বিষয়টি বিবেচনা করছে।
অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য: এই চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুল্ক হ্রাস বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতা ধরে রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াবে। তবে, কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত আমদানি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি অপ্রয়োজনীয় বা ব্যয়বহুল হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই শুল্ক নীতি বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং মার্কিন পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, মার্কিন প্রশাসন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা এই আলোচনায় একটি ভূ-রাজনৈতিক মাত্রা যোগ করেছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ: যদিও শুল্ক হ্রাস বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক, তবে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের স্নাতক হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্ভাব্য শুল্ক আরোপের বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এছাড়া, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, সরকার এবং শিল্প নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি ইউরোপ, কানাডা এবং জাপানের মতো বাজারে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে শুল্ক হ্রাসের জন্য আরও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি আংশিক স্বস্তি এনেছে, তবে এটি অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এসেছে। বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি এবং আলোচনার ফলে এই শুল্ক হ্রাস সম্ভব হয়েছে, যা দেশের রপ্তানি বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে সহায়ক হবে। তবে, দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশকে তার রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।