সেহলী পারভীন, নির্বাহী সম্পাদক, আইবিএন নিউজ: ২১ জুলাই ২০২৫, রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান (এফ-৭ বিজিআই) বিধ্বস্ত হয়ে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। এই ঘটনায় ছোট্র কোমলমতি শিশুদের প্রাণহানি ও শত শত শিক্ষার্থী-শিক্ষক আহত হয়েছেন, যা জাতির জন্য এক গভীর শোকের মুহূর্ত। এই ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং সরকারের সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বহীন আচরণ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার এক মর্মান্তিক প্রতিফলন।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যা ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০২৪ সালে ২০,২৩৬ জন শিক্ষার্থীর শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, এই দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুপুর ১:১৮ মিনিটে বিমানটি কলেজের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়, যার ফলে বহু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আগুনে দগ্ধ হন। ২২ জুলাই আইএসপিআরের তথ্যমতে, এ ঘটনায় ৩১ জন নিহত ( সর্বশেষ ৩৩) এবং ১৬৫ জন আহত হয়েছেন, যদিও সামাজিক মাধ্যমে ১০০-এর বেশি মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক থেকে ২৯ জনের মৃত্যু সংখ্যা উল্লেখ করে একটি পোষ্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তথ্য বিভ্রাট দেখা যায়। এই যখন অবস্থা তখন এই সংখ্যার অসঙ্গতি অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে, যারা তাদের সন্তানদের সঠিক অবস্থা জানতে হাসপাতাল ও কলেজ প্রাঙ্গণে ভিড় করছেন।
এই দুর্ঘটনার পর সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রতুল এবং সমন্বয়হীন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শোকবার্তা জানালেও, তথ্যের স্বচ্ছতা ও দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রমে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। উদ্ধার কার্যক্রমে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি অংশ নিলেও, প্রাথমিক তথ্য প্রকাশে ধীরগতি এবং হতাহতের সংখ্যা নিয়ে অসঙ্গতি জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে একজনের মৃত্যু নিশ্চিত করলেও, পরবর্তীতে সংখ্যা বাড়তে থাকে, যা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি করেছে।
২২ জুলাই সকালে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন এবং দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকেন। শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে সরকারের তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলেছে। এই ঘটনা সরকারের জনগণের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্নতার প্রমাণ। উপদেষ্টারা শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও, তাদের পলায়নমূলক প্রস্থান জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য তহবিল সংকটের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। এই পদক্ষেপকে অনেকে ‘ভিক্ষা’ হিসেবে উপহাস করেছেন, যা সরকারের অর্থনৈতিক অক্ষমতা ও পরিকল্পনার ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৬৪ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা চলছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু। অভিভাবকরা হাসপাতালের সামনে ভিড় করে তাদের সন্তানদের অবস্থা জানার চেষ্টা করছেন, কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে তাদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৪৬ জন শিক্ষার্থী নিখোঁজের খবর এই উৎকণ্ঠাকে আরও তীব্র করেছে।
এই ট্র্যাজেডি জাতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। শিক্ষার্থীদের প্রাণহানি, শিক্ষকদের আহত হওয়া এবং অভিভাবকদের মানসিক যন্ত্রণা আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সরকারের উচিত ছিল দ্রুত তথ্য প্রকাশ, স্বচ্ছ তদন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। কিন্তু তথ্য গোপন, উপদেষ্টাদের অবরোধ এবং সেনাবাহিনীর শিক্ষার্থীদের উপর হামলার অভিযোগ জনগণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি—নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের নির্ভুল তালিকা, ক্ষতিপূরণ, ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সংস্কার এবং শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য ক্ষমা—যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, এই দাবিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না।
মাইলস্টোন কলেজ ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের প্রশাসনিক অদক্ষতা, স্বচ্ছতার অভাব এবং দায়িত্বশীলতার ঘাটতির একটি মর্মান্তিক প্রতিফলন। জাতি হিসেবে আমাদের এই ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরাপদ আকাশসীমা, আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছ শাসন নিশ্চিত করতে হবে। এই শোকের মুহূর্তে আমরা নিহতদের মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনা করি।