ইয়াঙ্গুন, ৩১ জুলাই ২০২৫: মায়ানমারের সামরিক জান্তা বৃহস্পতিবার দেশে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জারি থাকা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জান্তা আগামী ডিসেম্বরে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ হিসেবে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এটিকে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার একটি কৌশল হিসেবে সমালোচনা করেছেন।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। এই আদেশ তাকে আইনসভা, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদান করেছিল। তবে, সম্প্রতি তিনি নির্বাচনকে সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার একটি পথ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জান্তার মুখপাত্র জাও মিন তুন সাংবাদিকদের কাছে একটি অডিও বার্তায় বলেন, “আজ জরুরি অবস্থা বাতিল করা হয়েছে যাতে দেশটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে।” তিনি আরও জানান, নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের প্রশিক্ষণ সেশন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
মিন অং হ্লাইং নেপিডোতে একটি বক্তৃতায় বলেন, “আমরা প্রথম অধ্যায় পার করে এসেছি। এখন আমরা দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করছি।” তিনি জানান, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সকল যোগ্য ভোটার যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে জন্য প্রচেষ্টা চলবে। তবে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
বিরোধীদের বর্জন ও সমালোচনা: অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সহ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক আইনপ্রণেতারা এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা জান্তা-নিযুক্ত ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশনকে অবৈধ বলে অভিহিত করেছেন এবং নির্বাচনকে একটি ‘প্রহসন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ গত মাসে এই নির্বাচনকে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার একটি ‘প্রতারণা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গত বছর নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে পরিচালিত একটি আদমশুমারিতে দেশের ৫১ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১৯ মিলিয়ন মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হিসেবে ‘নিরাপত্তাগত সীমাবদ্ধতা’ উল্লেখ করা হয়েছে, যা চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যে নির্বাচনের সীমিত পরিধি নির্দেশ করে।
নতুন আইন ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ: বুধবার, সামরিক সরকার একটি নতুন আইন পাশ করেছে যার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ‘ধ্বংস’ করার লক্ষ্যে বক্তৃতা বা বিক্ষোভের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। এছাড়া, মিন অং হ্লাইং নিজেকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন ‘ইউনিয়ন সরকার’ এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি কমিশন’ গঠন করেছেন, যেখানে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জান্তার মিত্র চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মায়ানমারের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পার্থক্য নিরসনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। তবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাকে মায়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
চলমান সংঘাত: ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমার একটি বহুমুখী গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত, যাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, নির্যাতন এবং গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বিরোধী গোষ্ঠী এবং জাতিগত সংখ্যালঘু মিলিশিয়ারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের সময় বিরোধীরা তাদের বিরোধিতা প্রকাশের জন্য নতুন করে আক্রমণ চালাতে পারে।
মায়ানমারের সামরিক জান্তা জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করলেও, এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। বিরোধীদের বর্জন এবং চলমান সংঘাতের মধ্যে এই নির্বাচন কতটা গণতান্ত্রিক হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই প্রক্রিয়ার উপর নজর রাখছে, যখন মায়ানমারের জনগণ একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আশায় রয়েছে।