আইবিএন রিপোর্ট: বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে সম্প্রতি সংঘটিত সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক স্বাধীন বেসরকারি সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ICRF) জাতিসংঘের নৈতিকতা দপ্তরে একটি চিঠি প্রেরণ করেছে। এই চিঠিতে গোপালগঞ্জে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল অবমাননার চেষ্টা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। ICRF এই ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘের কাছে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
গোপালগঞ্জে সহিংসতার প্রেক্ষাপট:
১৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে গোপালগঞ্জে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান এবং সমাধিস্থলে, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (NCP) নামে একটি নিবন্ধনবিহীন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার সমর্থক মিছিল নিয়ে প্রবেশ করে। ICRF-এর চিঠি অনুযায়ী, এই মিছিলের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল অবমাননা ও ধ্বংস করা। এই ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিরোধ গড়ে তুললে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি এবং দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়, এবং ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়।
ICRF-এর অভিযোগ, এই সংঘর্ষের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী NCP-এর সমর্থকদের পক্ষ নিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালিয়েছে, যার ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাতের শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে যে, সেনাবাহিনীর গাড়িতে NCP-এর প্রতিবাদকারীদের লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, যা সেনাবাহিনী এবং NCP-এর মধ্যে সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
ICRF-এর চিঠি এবং দাবি:
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ICRF তাদের চিঠিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের কাছে গোপালগঞ্জে সংঘটিত ঘটনার স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী NCP-এর সঙ্গে মিলে বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল অবমাননার চেষ্টায় সহায়তা করেছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। এই ঘটনাকে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধ্বংসের প্রচেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ICRF আরও দাবি করেছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনতে হবে, বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের অভিযোগের জন্য। তারা জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি তদন্ত মিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে যাতে এই ঘটনার সত্যতা উদঘাটন করা যায়।
ইউনুস সরকার এই সহিংসতার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে। তবে, ICRF-এর চিঠিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং NCP-এর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক:
গোপালগঞ্জের ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তীব্র হয়েছে। ICRF-এর অভিযোগের পাশাপাশি, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবি উঠেছে। সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাতের শেয়ার করা ভিডিওটি এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে, সেনাবাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। বিবিসি জানিয়েছে, তারা সেনাবাহিনীর মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ:
গোপালগঞ্জের ঘটনা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এর আগে, বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (MASUM) এবং হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিস (HRCBM) সহ বিভিন্ন সংগঠন দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা এবং আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে। HRCBM সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার অপব্যবহার বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
এছাড়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন প্রণয়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
ICRF-এর চিঠি জাতিসংঘের নৈতিকতা দপ্তরে পৌঁছানোর পর এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘ যদি এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত মিশন গঠন করে, তবে এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির করুণ পরিস্থিতি প্রকাশ পেয়েছ। ICRF-এর চিঠি এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরেছে, এবং এখন সবার দৃষ্টি জাতিসংঘের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এই অভিযোগের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এবং স্বচ্ছ তদন্তের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এই ঘটনা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মানবাধিকারের প্রতি ড. ইউনুস সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।